
নিজস্ব প্রতিবেদক :: মাত্র তিন বছর আগে গৃহীত হয়েছিল বরিশাল জেলা শিল্পকলা একাডেমির ভবন। আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই স্থাপনাটি আজ তদারকির অভাব ও অব্যবস্থাপনার কারণে ধ্বংসপ্রায়। বরিশালের সংস্কৃতি চর্চার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত স্থাপনাটি এখন চরম অব্যবস্থাপনা, চুরি, ভাঙচুর এবং যন্ত্রপাতি বিকল হয়ে পড়ার কারণে কার্যত অচল হয়ে আছে।
নির্মাণের পর এক সময় এই ভবনের সৌন্দর্য ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে সাংস্কৃতিক মহলে ব্যাপক আগ্রহ ও উচ্ছ্বাস থাকলেও, বাস্তবতা এখন পুরোপুরি ভিন্ন। অডিটোরিয়ামের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) ব্যবস্থা ৬ মাসের বেশি সময় ধরে বিকল হয়ে আছে। তার বাইরে থাকা কপার তার চুরি হয়ে যাওয়ায় সম্পূর্ণ ব্যবস্থাটি অকেজো হয়ে পড়ে। প্রায় প্রতিদিনই ভবনের বিভিন্ন স্থান থেকে চুরি ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটছে। অডিটোরিয়ামের অত্যাধুনিক এলইডি মনিটরটি দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট। সিলিং বিভিন্ন জায়গা থেকে খুলে পড়ছে, দেয়ালজুড়ে নোনা ধরেছে।
এছাড়া, ভবনের আশপাশে বস্তিবাসী ও মাদকসেবীদের আনাগোনা বাড়ায় একাডেমি ভবনটি অনেকটা বখাটেদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারে সাম্প্রতিক সময়ে চারজন আনসার নিয়োগ করা হয়েছে।
বরিশালের বর্তমান জেলা কালচারাল অফিসার অসিত বরণ দাশ গুপ্ত জানান, তিনি চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি দায়িত্ব নেয়ার পর শিল্পকলা একাডেমির এই বেহাল চিত্র সামনে পান। দায়িত্ব নেয়ার পর তিনি জেলা প্রশাসক দেলোয়ার হোসেনের সহায়তায় পরিস্থিতি পরিবর্তনে উদ্যোগী হন। নিজস্ব প্রচেষ্টায় সংস্কার কাজ শুরুর ইচ্ছা থাকলেও আর্থিক সীমাবদ্ধতায় তা সম্ভব হয়নি। প্রাথমিকভাবে মেরামতের জন্য প্রায় ৯ লাখ টাকার প্রয়োজন নির্ধারণ করা হয়। এরপর তিনি বরিশাল গণপূর্ত বিভাগের সহযোগিতা চেয়ে গত ৮ মে লিখিতভাবে ব্যয় প্রাক্কলনের আবেদন করেন। গণপূর্ত বিভাগ দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছে বলে জানান তিনি।
অসিত বরণ দাশ গুপ্ত আরও জানান, সংস্কৃতি চর্চা অব্যাহত রাখতে বরিশালের সব সাংস্কৃতিক সংগঠনকে একত্রিত করে সম্মিলিতভাবে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। তিনি বলেন, “এত সুন্দর একটি স্থাপনা শুধু অবহেলা আর দুর্নীতির কারণে ধ্বংস হয়ে যাবে এটা মেনে নেয়া যায় না। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করছি এটিকে সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্রে রূপান্তর করতে।”
অন্যদিকে নগরীর সচেতন মহল এবং সংস্কৃতি সংগঠকরা অভিযোগ করেছেন, ভবন নির্মাণের কাজ অত্যন্ত নিম্নমানের হয়েছে। নির্মাণের তিন বছরের মাথায় সিলিং খসে পড়া, দেয়ালে নোনা ধরা এবং প্লাস্টার খসে যাওয়াটা প্রকৃতপক্ষে দুর্বল নির্মাণের ইঙ্গিত দেয়। গণপূর্ত বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের বিরুদ্ধে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
বরিশাল গণপূর্ত বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী কাজী জিহাদ জানান, ভবনটি ৩ বছর আগে হস্তান্তর করা হয়। বর্তমানে যে সমস্যাগুলো দেখা দিয়েছে, সেগুলো দ্রুত সমাধানের জন্য তারা কাজ করছেন। তিনি বলেন, “অডিটোরিয়ামের এসিগুলো সাধারণ এসির মতো নয়। বিশেষজ্ঞ দিয়ে এগুলো মেরামতের জন্য ব্যয় প্রাক্কলন প্রস্তুত করা হচ্ছে। এরপর সংস্কার কাজ শুরু হবে।”
উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে বরিশাল শিল্পকলা একাডেমির নতুন ভবনের উদ্বোধন হয় এবং ২০১৬ সালের ৪ জানুয়ারি নির্মাণকাজ শুরু করে গণপূর্ত বিভাগ। ডিভিশনাল ও জোনাল শিল্পকলা একাডেমি নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় প্রায় ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ভবনটি নির্মাণ করা হয়। নির্মাণে পাঁচ বছর সময় লেগে গেলেও এটি শেষ পর্যন্ত বরিশালের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের এক নতুন দিগন্তের সূচনা করবে বলে আশাবাদী ছিলেন সবাই।
চারতলা বিশিষ্ট এই ভবনে রয়েছে আধুনিক ৫০০ আসনের অডিটোরিয়াম, উন্মুক্ত মঞ্চ, আর্ট গ্যালারি, লাইব্রেরি, রেস্ট হাউজ ও অফিস কক্ষসহ নানা সুযোগ-সুবিধা। কিন্তু বর্তমানে অকেজো হয়ে যাওয়া এসি, নষ্ট অডিও-ভিজ্যুয়াল সিস্টেম ও অরক্ষিত পরিবেশের কারণে এখানে বড় ধরনের কোনো অনুষ্ঠান হচ্ছে না।
সব মিলিয়ে বলা যায়, অবহেলা, দুর্নীতি, নিম্নমানের নির্মাণ ও যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে আধুনিক শিল্পকলা ভবনটি আজ ধ্বংসের মুখে। সংস্কৃতির এই গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রটিকে টিকিয়ে রাখতে হলে দ্রুত সংস্কার ও সুশাসন নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।