
নিউজ ডেস্ক :: হুমকি ও সহিংসতার আশঙ্কার গোয়েন্দা তথ্য থাকার পরও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) গোপালগঞ্জে গত বুধবারের জুলাই পদযাত্রা এবং সমাবেশ ঘিরে ব্যাপক সহিংসতা হয়েছে। ঘটনার সময় দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তাদের কার কী দায়িত্ব ছিল এবং কে কী ভূমিকা রেখেছে; কার দায় কতটুকু ছিল, সেটারও চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। পর্যালোচনা করা হচ্ছে বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ। পুলিশের দায়িত্বশীল মহল বলছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কারও প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রচলিত বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বুধবারের ঘটনায় সরকারের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনিকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য দুই সদস্য হিসেবে থাকছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং আইন ও বিচার বিভাগের একজন করে অতিরিক্ত সচিব। পুলিশ আনুষ্ঠানিক কোনো তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা দিলেও তারা অভ্যন্তরীণভাবে বিষয়টির বিস্তর অনুসন্ধান করছে। সেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের কোনো গাফিলতি বা অবহেলা ছিল কি না, সেটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তাদের সমস্যাগুলোও চিহ্নিত করে প্রতিকারের কাজ চলছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের আইজি বাহারুল আলম বৃহস্পতিবার কালবেলাকে বলেন, ‘এরই মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব গণমাধ্যমকে বিষয়টি জানিয়েছেন। এরপর পুলিশের আর নতুন করে তদন্ত কমিটি গঠনের দরকার নেই। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি যা যা সুপারিশ করবে, সেগুলো বাস্তবায়ন করা হবে।’
আইজিপি বাহারুল আলম আরও বলেন, ‘ধৈর্য সহকারে পুলিশ গোপালগঞ্জের পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করেছে। গোপালগঞ্জে আমরা প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করিনি, তাই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে একটু সময় লেগেছে। বিশৃঙ্খলা যা হয়েছে, সেটা যতটুকু সম্ভব আমরা ধৈর্যের সঙ্গে প্রশমন করার চেষ্টা করছি। যখনই পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে থাকে, সেটা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য পরে অতিরিক্ত পুলিশ ফোর্স পাঠানো হয়েছে।’
এদিকে বুধবারের ঘটনায় এনসিপি সরাসরি অভিযোগ করে বলেছে ‘সেখানে (গোপালগঞ্জে) পুলিশের ভূমিকা সন্তোষজনক ছিল না। পুলিশসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সচেতন থাকলে এ হামলা ও সহিংসতা ঠেকানো যেত।’ সংগঠনটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘জুলাই পদযাত্রায় আমরা যেখানে গিয়েছি প্রশাসন ও পুলিশকে অবহিত করেছি। তাদের ক্লিয়ারেন্স নিয়েছি এবং তারা যে নির্দেশনা দিয়েছে, সেগুলো অনুসরণ করেছি। এরপরও আমাদের হত্যার উদ্দেশ্যে এমন ভয়ানক হামলা দুঃখজনক। পুলিশ ও প্রশাসন আরেকটু তৎপর থাকলে এমনটা হতো না।’
এদিকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছে, গোপালগঞ্জের ঘটনার তদন্তে যে কমিটি করা হয়েছে তাদের দুই সপ্তাহের মধ্যে একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত পরিচালনা এবং প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ন্যায়বিচার ও জনশৃঙ্খলা বজায় রাখার এবং যে কোনো বেআইনি কাজ ও সহিংসতার জন্য দায়ীদের আইন অনুসারে জবাবদিহি করার প্রতিশ্রুতি রয়েছে।’
এদিকে, ‘গোপালগঞ্জে যে বড় ধরনের সহিংসতা ঘটবে, সে তথ্য গোয়েন্দাদের কাছে ছিল না বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘গোপালগঞ্জের পরিস্থিতি এখন শান্ত। বুধবারের ঘটনার সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। এ ঘটনায় যারা জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। এখানে কোনো রাজনৈতিক পরিচয় দেখা হবে না। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে যে কোনো দল প্রশ্ন করতে পারে। এতে সরকারের বলার কিছু নেই।’
সহিংসতার গোয়েন্দা তথ্য ছিল:
গোপালগঞ্জে এনসিপির জুলাই পদযাত্রা ও সমাবেশের নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে চলতি মাসের শুরুর দিকে পুলিশের উচ্চপর্যায়ের একটি সভায় বিশদ আলোচনা হয়। মাঠপর্যায়ে গোয়েন্দা তথ্য অনুসন্ধান করে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মনিটরিং করে গোপন প্রতিবেদনও প্রস্তুত করা হয়েছিল। পুলিশের বিশেষ শাখা ওই গোপনীয় প্রতিবেদন ঘটনার প্রায় ১০ দিন আগেই পুলিশ সদর দপ্তর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। প্রতিবেদনে গোপালগঞ্জে জুলাই পদযাত্রার কর্মসূচি ঘিরে সার্বিক নিরাপত্তার হুমকির বিষয়টি তুলে ধরা হয়। ঘটনার আগের রাতে আত্মগোপনে থাকা শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য নিয়েও পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহলকে অবহিত করা হয়। এ ছাড়া ঘটনার আগের দিন মঙ্গলবার পুলিশ সদর দপ্তরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার উপস্থিতিতে সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। ওই আলোচনায় আইজিপিসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন ওই বৈঠকে। আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিক ও গোপালগঞ্জের এসপি মিজানুর রহমান। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার উপস্থিতিতে গোপালগঞ্জে এনসিপির কর্মসূচির নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও নিরাপত্তা প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা হয়। জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে সেখানে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) ১০০ সদস্য মোতায়েনের কথা জানানো হয়। রেঞ্জ অফিসের পক্ষ থেকে আরআরএফের (রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্স) ১৫০ সদস্য মোতায়েনের কথা জানানো হয়। পাশাপাশি জেলা পুলিশের নিয়মিত ফোর্স দায়িত্ব পালন করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। জেলা পুলিশ ফোর্সের পাশাপাশি অতিরিক্ত ২৫০ সদস্য দিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব বলে জানানো হয়।
এদিকে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে হুমকি ও সহিংসতার আশঙ্কার বিষয়টি উল্লেখ থাকার পরও কীভাবে এত বড় সহিংসতা হয়েছে, গতকাল দিনভর পুলিশ সদর দপ্তরে তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। বলা হচ্ছে, মাঠপর্যায় থেকে চাইলে আরও বেশি ফোর্স দেওয়া যেত। কিন্তু যে সংখ্যায় চাওয়া হয়েছে, সে অনুযায়ী ফোর্স মোতায়েন থাকার পরও কেন এ ধরনের হামলা হলো, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ ছাড়া পুলিশ এনসিপির কর্মসূচির আগে গোপালগঞ্জ সদরসহ বিভিন্ন উপজেলায় চিরুনি অভিযান চালায়। সেখানে সন্দেহভাজনদের আটক করে। তারপরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। বুধবার পরিস্থিতি যখন খারাপ হতে থাকে, তখন আইজিপির নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আরও ১০০ সদস্য পাঠানো হয় পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে। উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে দুপুরের পর পুলিশ সদর দপ্তরে ছুটে যান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এবং স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। আগে থেকেই সদর দপ্তরে ছিলেন আইজিপি। তারা সেখানে বসে গোপালগঞ্জের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেন। শেষ পর্যন্ত পুলিশ ও সেনাবাহিনী মিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
মুহূর্তেই চলে আসে হাজার হাজার লোক:
গোপালগঞ্জ জেলায় কর্মরত পুলিশের এক সদস্য জানান, আমরা আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলাম যে, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা করতে পারে। ছাত্রলীগ, যুবলীগের লোকজন ছদ্মবেশে খণ্ড খণ্ডভাবে গোপালগঞ্জ শহরের অলিগলিতে অবস্থান নিতে থাকে। এনসিপি নেতারা সমাবেশ শেষ করা মাত্র মুহূর্তের মধ্যে চারপাশ থেকে হাজার হাজার লোক জড়ো হয়ে ভাঙচুর শুরু করে। পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেল ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। পুলিশ টিয়ার গ্যাসের শেল ছোড়ে ও লাঠিপেটা করে। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় তখন মনে হচ্ছিল যুদ্ধ চলছে, পুরো এলাকা রণক্ষেত্র। চারদিক থেকে ইটপাটকেল ও ককটেল নিক্ষেপ করা হচ্ছিল। মঞ্চ ও স্থাপনায় আগুন দেওয়া হয়। যারা সমাবেশকারীদের প্রতিরোধ করতে আসে, তারাও কিছুতেই পিছু হটছিল না।’
গোপালগঞ্জের বুধবারের পরিস্থিতি নিয়ে আইএসপিআর বলেছে, একটি রাজনৈতিক সংগঠনের সমাবেশ চলাকালে মঞ্চে হামলা চালানো হয়। একই সঙ্গে জেলা কারাগারে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়। এ অবস্থায় সেনাবাহিনী মাইকে বারবার ঘোষণা দিয়ে হামলাকারীদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলে তারা সেনাবাহিনীর ওপর হামলা করে এবং বিপুলসংখ্যক ককটেল, ইটপাটকেল ছুড়ে মারে। একপর্যায়ে সেনাবাহিনী আত্মরক্ষার্থে বলপ্রয়োগে বাধ্য হয়। পরে সেনাবাহিনী, বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) ও পুলিশ যৌথভাবে বিশৃঙ্খলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। একপর্যায়ে গোপালগঞ্জে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আশ্রয় নেওয়া ব্যক্তিদের সেনাবাহিনীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে খুলনায় নিয়ে যাওয়া হয়। সর্বোপরি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পেশাদারিত্ব ও ধৈর্যের সঙ্গে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।
নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি:
এদিকে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এক বিবৃতিতে বলেছে, অবিলম্বে একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও পূর্ণাঙ্গ তদন্ত কমিটি গঠন করে গোপালগঞ্জের ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান করতে হবে। এনসিপির নেতা ও সমর্থকদের ওপর ন্যক্কারজনক হামলার পেছনে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে হবে। পাশাপাশি সমাবেশে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্বে থাকা কর্তৃপক্ষের কোনো গাফিলতি ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখার আহ্বান জানিয়েছে আসক।