
নিউজ ডেস্ক :: জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে হাজার হাজার মানুষ রাজপথে নেমে বাংলাদেশের কর্তৃত্ববাদী সরকারকে উৎখাত করেছিল। এরপর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এক বছর ধরে ক্ষমতায় আছে সেই সরকার। কিন্তু মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার মানবাধিকার রক্ষার চ্যালেঞ্জিং কর্মসূচি বাস্তবায়নে ব্যর্থ হচ্ছে।
বুধবার (৩০ জুলাই) যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব কথা বলেছে। এটি গতকাল এইচআরডব্লিউর ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
এইচআরডব্লিউ বলছে, শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে যে ভীতি, দমন-পীড়ন ও গুমের মতো ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটত, তার কিছুটা অবসান ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার কথিত রাজনৈতিক বিরোধীদের দমনে নির্বিচার আটক করছে। মানবাধিকার সুরক্ষায় তারা এখনো কাঠামোগত সংস্কার আনতে পারেনি।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের উপপরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, মানবাধিকারভিত্তিক গণতন্ত্র গড়ার আশায় এক বছর আগে যারা শেখ হাসিনার নিপীড়নমূলক শাসনের বিরুদ্ধে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন, তাদের সেই আশা এখনো পূরণ হয়নি।
তিনি আরও বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার যেন এক জায়গায় আটকে আছে। একদিকে সংস্কারবিহীন নিরাপত্তা বাহিনী, অন্যদিকে মাঝেমধ্যে সহিংস ধর্মীয় কট্টরপন্থী এবং এমন কিছু রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে সামলাতে হচ্ছে, যারা বাংলাদেশিদের অধিকার রক্ষার চেয়ে শেখ হাসিনার সমর্থকদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে বেশি আগ্রহী।
২০২৪ সালে গঠিত ১১টি সংস্কার কমিশন, জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় ও দেশি-বিদেশি মানবাধিকারকর্মীরা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে যেসব বিস্তারিত সুপারিশ দিয়েছে, যা এখনো বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রয়েছে।
এদিকে সরকার বিপুল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। যেমন উচ্ছৃঙ্খল জনতার সহিংসতা (মব ভায়োলেন্স), রাজনৈতিক সহিংসতা এবং রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য চরমপন্থী গোষ্ঠীর বিশেষ করে নারী অধিকার, সমকামী, উভকামী ও ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিবিরোধী ধর্মীয় কট্টরপন্থীদের হাতে সাংবাদিকদের হয়রানি উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে চলছে।
গত ২৬ ও ২৭ জুলাই রংপুর জেলায় হিন্দু সংখ্যালঘুদের অন্তত ১৪টি বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত করেছে একদল উচ্ছৃঙ্খল জনতা। আর পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে।
টানা পাঁচ সপ্তাহের বিক্ষোভের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। জাতিসংঘের তথ্যমতে, পাঁচ সপ্তাহের বিক্ষোভে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে ১ হাজার ৪০০ মানুষ নিহত হন। নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। কিন্তু এখনো হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে, যা নিরাপত্তা খাতে জরুরি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরছে।
গত ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তা বাহিনী ও বর্তমানে নিষিদ্ধ (কার্যক্রম) আওয়ামী লীগের সমর্থকদের সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত হন। গত বছরের গণ-আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে গঠিত হয় জাতীয় নাগরিক পার্টি।
অতীতের দলীয় পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের পুনরাবৃত্তির মতোই পুলিশ পরে নির্বিচার শত শত কথিত আওয়ামী লীগ সমর্থককে আটক করে। ৮ হাজার ৪০০ জনের বিরুদ্ধে ১০টি হত্যা মামলা করে। এই মামলার আসামিদের বেশির ভাগই অজ্ঞাত ব্যক্তি। তবে সরকার ‘গণগ্রেপ্তারের’ অভিযোগ নাকচ করেছে।
২০২৪ সালের ৬ আগস্ট থেকে ২৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পুলিশ ৯২ হাজার ৪৮৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে, অধিকাংশের বিরুদ্ধে অভিযোগ হত্যার। ১ হাজার ১৭০টির বেশি মামলায় প্রায় ৪০০ সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতা-কর্মীর নামোল্লেখ করা হয়েছে। এসব মামলায় আরও অজ্ঞাতনামা শত শত ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে সরবরাহ করা তথ্যে দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম ২০২৪ সালের আন্দোলনকালের হত্যা বা হত্যাচেষ্টার অন্তত ৬৮টি মামলার আসামি হয়ে গত অক্টোবর থেকে কারাগারে আছেন। তবে এসব ঘটনার মধ্যে ৩৬টি ঘটেছিল এমন সময়ে, যখন তিনি দেশের বাইরে ছিলেন। অন্য অনেক ঘটনার মতো এখানেও আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করা হয়নি। অন্যান্য বড় রাজনৈতিক মামলায় আটক ব্যক্তিরাও অভিযোগ করছেন, তাদের ভিত্তিহীন অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের চিকিৎসাসেবা ও জামিন থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।
প্রথম মামলার বিচার ৩ আগস্ট শুরু হওয়ার কথা। যেখানে অভিযুক্ত তিনজনের একজন শেখ হাসিনা, যার অনুপস্থিতিতেই বিচার চলবে। তবে অনেক মামলার বিচার শুরুর কোনো দৃশ্যমান সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। আর যাদের আটক করা হয়েছে, তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি।
দমনমূলক বিশেষ ক্ষমতা আইনের অধীনে শত শত মানুষকে আটক করা হয়ে থাকতে পারে। এই আইনে অভিযোগ ছাড়াই যে কাউকে আটক করা যায়। আগের সরকার ভিন্নমত দমনে এই আইন ব্যবহার করেছিল।
এ ছাড়া গত ফেব্রুয়ারিতে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নামের অভিযানে ৮ হাজার ৬০০ জনের বেশি মানুষকে ধরপাকড় করা হয় বলে জানা গেছে, যাদের অনেকে আওয়ামী লীগের সমর্থক বলে অভিযোগ।
গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে অনেককেই নির্বিচার ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আটক করা হয়েছে। অন্যদিকে শেখ হাসিনার শাসনামলে নিরাপত্তা বাহিনীর যেসব সদস্য গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাদের খুব কমসংখ্যক ব্যক্তির বিরুদ্ধেই সরকার মামলা করেছে।
বাংলাদেশ পুলিশের একজন মুখপাত্র বিবিসিকে বলেছেন, গত বছরের জুলাই ও আগস্টে সংঘটিত প্রাণঘাতী সহিংসতার ঘটনায় মাত্র ৬০ পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত বছরের ওই সহিংসতার ঘটনায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য কুখ্যাত র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নসহ (র্যাব) পুলিশ ও সেনাবাহিনীর অনেকগুলো ইউনিট অংশ নিয়েছিল।
অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৪ সালের ২৭ আগস্ট শেখ হাসিনার আমলে সংঘটিত গুমের ঘটনা তদন্তে একটি কমিশন গঠন করে। একদিন পর ২৯ আগস্ট ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দ্য প্রোটেকশন অব অল পারসন্স ফ্রম এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স বা গুম থেকে প্রত্যেক মানুষের সুরক্ষা সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক সনদ আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন করে বাংলাদেশ। গুম কমিশন এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৮০০টির বেশি অভিযোগ পেয়েছে। তারা এরই মধ্যে দুটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। আরেকটি আগামী ডিসেম্বরে প্রকাশের কথা রয়েছে।
কমিশনের সদস্যরা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন, তারা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অনেক প্রমাণ নষ্ট করেছে, সহযোগিতা কমিয়ে দিয়েছে এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনতে বাধা দিচ্ছে। অভিযুক্ত সদস্যদের অনেকেই এখনো বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থায় কর্মরত রয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত নিরাপত্তা বাহিনীর বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন।
ইউনূস সরকার পুলিশ, বিচার বিভাগ, নারী অধিকারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আইন ও সংবিধান সংস্কারের জন্য ১১টি কমিশন গঠন করেছে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার সেগুলো গ্রহণ করেনি। রাজনৈতিক ঐকমত্যে পৌঁছার জন্য সংস্কার কর্মসূচি উল্লেখযোগ্যভাবে সংকুচিত করা হলেও সেই চেষ্টা বেশ ধীর হয়ে পড়েছে।
সব ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীদের সম্পূর্ণ, সমান, অর্থবহ এবং নিরাপদ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে। বিষয়টি নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কারসহ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ১৩২৫ নম্বর প্রস্তাবের সঙ্গে সংগতি রেখে করার কথা বলা হয়েছে।
নিজেদের সময়কালের পরেও যাতে মানবাধিকার রক্ষায় সহায়ক হয়, সে জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বিচার আটক বন্ধ করা উচিত। বিশেষ করে, বিচার শুরু হওয়ার আগেই আটক রাখা যে নিয়ম নয়, বরং ব্যতিক্রম—এ বিষয়টি তাদের নিশ্চিত করা উচিত। নিরাপত্তা বাহিনীর যেসব সদস্য গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত, তাদের বিচারকে সমর্থন করার মধ্য দিয়ে দায়মুক্তি দেওয়া বন্ধ করা উচিত।
নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। নিরাপত্তা খাতের সংস্কার শুরু করা উচিত, যার মধ্যে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বিলুপ্ত করা অন্যতম। নারীর অধিকার ও নারীদের পূর্ণ প্রতিনিধিত্বকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, বিদেশি সরকার ও জাতিসংঘকে এই অন্তর্বর্তী সরকারকে সহায়তা করা উচিত। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে এটা করা যেতে পারে। সংশ্লিষ্ট সরকারগুলোর উচিত বাংলাদেশ ত্যাগ করা ব্যক্তিদের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে, তাদের বিচার করা। প্রয়োজনে এ ক্ষেত্রে সর্বজনীন বিচারব্যবস্থাকে (ইউনিভার্সাল জুরিসডিকশন) কাজে লাগানো যেতে পারে। তাদের (বিদেশি সরকার ও জাতিসংঘকে) স্পষ্ট করতে হবে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের গুরুতর লঙ্ঘনের জবাবদিহি নিশ্চিত করার ওপরই জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা অভিযানে বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণ নির্ভর করবে।
এইচআরডব্লিউর এশিয়া অঞ্চলের উপপরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, ‘ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার যে বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে, সে বিষয়ে কারও কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে সত্যিকারের ও টেকসই পরিবর্তন আনতে হলে এখন অনেক কাজ করা দরকার।’
মীনাক্ষী আরও বলেন, যেসব রাজনৈতিক দলের সদস্য অতীতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন, তাদের উচিত এ ধরনের অপরাধ যেন আর কখনো না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে সংস্কারের পক্ষে দাঁড়ানো এবং সবার অধিকার রক্ষায় সমর্থন জানানো।