
এ এইচ হুমায়ূন সম্পদ :: মেধার মূল্যায়ন হারিয়ে যাচ্ছে লটারির ঘূর্ণিপাকে।
বর্তমান মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থায় লটারিভিত্তিক ভর্তি পদ্ধতি একদিকে যেমন সমতার কথা বলে, অন্যদিকে তা বাস্তবতায় এক অদ্ভুত বৈষম্য ও অচলাবস্থার জন্ম দিচ্ছে। শ্রেণিকক্ষ যেন হয়ে উঠেছে দুই চাকা গরুর গাড়ির মতো — একটি চাকা ছোট, আরেকটি অনেক বড়। ফলে সেই গাড়ি সামনে না এগিয়ে শুধু এক জায়গায় ঘুরতেই থাকে।
একই শ্রেণিকক্ষে এখন দেখা যায়, কেউ খুবই মেধাবী, আবার কেউ একেবারেই প্রস্তুত নয়। শিক্ষকের পক্ষে এই বৈচিত্র্যময় শিক্ষার্থীদের এক ছাঁদে এনে পাঠদান করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ফলাফল — ক্লাস এগোয় না, পিছিয়ে পড়ে সবাই। যারা আগে থেকেই দুর্বল, তারা আরও পিছিয়ে যায়; আর যারা মেধাবী, তারাও চ্যালেঞ্জের অভাবে আগ্রহ হারায়।
শিক্ষা একটি চলমান প্রক্রিয়া, যেখানে ধারাবাহিকতা, প্রস্তুতি ও মান অনুযায়ী শ্রেণি বিন্যাস গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে লটারিভিত্তিক ভর্তি ব্যবস্থায় কেবল সৌভাগ্যই নির্ধারণ করছে কে কোথায় পড়বে — শিক্ষার্থীর আগ্রহ, যোগ্যতা, এমনকি প্রয়োজনীয় সহযোগিতাও উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে।
এই অবস্থা থেকে উত্তরণ জরুরি। নাহলে আমাদের শিক্ষাঙ্গনগুলো কেবলই এক জায়গায় ঘুরতে থাকবে — সামনে এগোবে না কখনোই। শিক্ষার্থীরা হারাবে ভবিষ্যতের স্বপ্ন, শিক্ষক হারাবেন প্রেরণা, আর দেশ হারাবে সম্ভাবনাময় মানবসম্পদ।
আরও কিছু সমস্যা নিচে তুলে ধরা হলো-
১. লটারি পদ্ধতিতে একজন মেধাবী শিক্ষার্থী ভর্তি থেকে বঞ্চিত হতে পারে, আর অপেক্ষাকৃত কম মেধার কেউ সুযোগ পেয়ে যায়। মেধাবীরা তাদের কাঙ্ক্ষিত প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা থেকে বঞ্চিত হয়। যে দেশে মেধার যথাযথ মূল্যায়ণ হয় না সে দেশে মেধাবী শিক্ষার্থীও তৈরি হয় না।
২. ভালো মানের স্কুলে ভর্তির সুযোগ পেতে লটারির ওপর নির্ভর করতে হয়, ফলে অনেক ভালো শিক্ষার্থী কম মানের স্কুলে ভর্তি হয়।
এতে সমান মানের শিক্ষা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে ও শিক্ষার মানে বৈষম্য সৃষ্টি হয়।
৩. শিক্ষার্থীরা পরিশ্রম করে ফল পাওয়ার চেয়ে ভাগ্যের ওপর বেশি নির্ভর করতে শেখে, যা দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক মানসিকতা তৈরি করে।
৪. ভর্তির ফলাফল সম্পূর্ণ ভাগ্যের ওপর নির্ভর করায় অভিভাবকরা অনিশ্চয়তায় ভোগেন।
অনেকে একাধিক স্কুলে আবেদন করেও সন্তানের জন্য উপযুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিশ্চিত করতে পারেন না
৫. বিকল্প পথ খোঁজার প্রবণতা (ভর্তি বানিজ্য)-
অনেকে বাধ্য হয়ে বেসরকারি বা ব্যয়বহুল স্কুলে ভর্তি করাতে বাধ্য হন।
কিছু ক্ষেত্রে অনৈতিকভাবে লটারির বাইরে সুযোগ পাওয়ার চেষ্টা করে দুর্নীতির সম্ভাবনা বাড়ে।
ভুয়া তথ্য দিয়ে একজন শিক্ষার্থীর একাধিক জন্ম নিবন্ধনের মাধ্যমে লিটারিতে একাধিক আবেদন করে।
কী ধরনের ভুয়া তথ্য সাধারণত দেওয়া হয়-
বয়স বেশি দেখানো: বয়স অনুযায়ী উচ্চতর শ্রেণীতে আবেদন করার সুযোগ তৈরি করা।
পূর্বের শ্রেণী ভুল দেখানো: যেমন, ৬ষ্ঠ শ্রণীতে ভর্তি হওয়ার জন্য, শিক্ষার্থী ২য় শ্রেণীতে পড়ছে কিন্তু ফর্মে দেখানো হলো সে ৫ম শ্রেণী পাশ করেছে।
ঠিকানা জাল: নির্দিষ্ট স্কুলের ক্যাচমেন্ট এলাকার মধ্যে পড়ার জন্য ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করা হয়।
ভুয়া ট্রান্সফার সার্টিফিকেট (TC): আগের স্কুলের ভুয়া সনদপত্র তৈরি করে জমা দেওয়া হয়।
৬. প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব হারিয়ে যাওয়া-
লটারিতে সুযোগ পাওয়ায় ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে মেধাভিত্তিক উন্নতির আগ্রহ কমে যায় এবং পরীক্ষার ভিত্তিতে নিজের উন্নতি পরিমাপ করার সুযোগও কমে যায়।
৭. গ্রাম ও শহরের বৈষম্য-
শহরের অভিভাবকরা লটারিতে অংশগ্রহণে বেশি সচেতন থাকলেও গ্রামীণ এলাকায় অনেক সময় তথ্য ঘাটতির কারণে শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ে।
লটারি পদ্ধতি হয়তো স্বচ্ছতা ও সমতা আনতে চেয়েছে, তবে এতে যোগ্যতার সঠিক মূল্যায়ন হয় না, যা দেশের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থায় দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এর পরিবর্তে মেধা ও আর্থসামাজিক বিবেচনায় সমন্বিত ভর্তি নীতিমালা হতে পারে একটি বিকল্প পন্থা।
উল্লেখ্য যে, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে (২০২১ শিক্ষাবর্ষের জন্য): কোভিড পরিস্থিতি বিবেচনায় সারা দেশের সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১ম–৯ম শ্রেণি পর্যন্ত ভর্তিতে ডিজিটাল লটারি চালু হয়, এবং এখন পর্যন্ত তা চলে আসছে। এর আগে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্য প্রার্থী বাছাই করে ভর্তি হতো। আর ডিজিটাল লটারি সিস্টেম এসে বিদ্যালয়গুলোকে জগাখিচুরিতে পরিনত করেছে।
এ এইচ হুমায়ূন সম্পদ
সহকারী শিক্ষক
বরিশাল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।


