
নিজস্ব প্রতিবেদক :: দুর্নীতির শীর্ষে পিআইও অয়ন সাহার : গ্রাম-গঞ্জের প্রকল্প লুটে ডুপ্লেক্স সাম্রাজ্য।
বরিশাল জেলার আগৈলঝাড়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) অয়ন সাহাকে কেন্দ্র করে যে দুর্নীতির কুখ্যাত অধ্যায় ঘনীভূত হয়েছে, তা যেন রাষ্ট্রীয় অনিয়মের এক স্থাপত্যশৈলী। স্থানীয়দের অভিযোগ—উন্নয়ন প্রকল্পের প্রতিটি ধাপে তিনি নাকি ‘কর্তৃত্ববাদী ঘুষযন্ত্রে’ পরিণত হয়েছেন। টিআর, কাবিখা, কাবিটা থেকে শুরু করে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বরাদ্দ—কোথাও নাকি তার “অফিস খরচ” নামের অব্যর্থ চাঁদাবাজি থেকে রেহাই নেই। যদিও প্রকল্প কর্মকর্তা সব অভিযোগকে ভিত্তিহীন দাবি করেছেন, তবুও মাঠপর্যায়ের নালিশগুলো দিনদিন আরও ঘনীভূত হচ্ছে।
দুর্নীতির টাকায় ‘গ্রামীণ ডুপ্লেক্স সাম্রাজ্য’
ফরিদপুরের হরিসভা গ্রামে গিয়ে দেখা যায় অয়ন সাহার অভিজাত তিনতলা ডুপ্লেক্স ভবন—যার স্থাপত্য দেখে স্থানীয়রা হতবাক। তাদের ভাষ্যমতে, তার পিতা অরূপ কুমার সাহা ছিলেন সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষ। কিন্তু অয়ন সাহার চাকরিতে যোগদানের পর পরিবারের আর্থিক অবস্থায় যে উল্লম্ফন ঘটেছে, তা স্বাভাবিক আয়-উৎসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করেন অনেকেই। স্থানীয়দের মতে, সরকারি চাকরির বেতন দিয়ে এ ধরনের সম্পত্তি গড়ে তোলা সম্ভব নয়—যা অনিয়মের গন্ধকেই আরও ঘনীভূত করে।
পূর্বের কর্মস্থল বানারীপাড়ায়ও ‘কোটির প্রকল্প লুণ্ঠন’
অভিযোগের তালিকা এত দীর্ঘ যে তা প্রায় দুর্নীতির এক ‘জ্যামিতিক ক্রমবৃদ্ধি’। বরিশালের বানারীপাড়ায় চাকরিকালীন সময়েও তিনি নাকি কোটি কোটি টাকার প্রকল্পে আর্থিক অনিয়ম করেছেন। বানারীপাড়ার উত্তরকুল গ্রামের মোজাম্মেল হক দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রধান কার্যালয়ে তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছেন। অভিযোগের অনুলিপিও পাঠানো হয়েছে বরিশাল জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস এবং তার বর্তমান কর্মস্থল আগৈলঝাড়া উপজেলা প্রশাসনে।
ঘুষের ‘৮%–১০% বাধ্যতামূলক কর’
আগৈলঝাড়ার একাধিক ইউপি সদস্য অভিযোগ করেন—প্রতি প্রকল্পে ৮% থেকে ১০% পর্যন্ত অঘোষিত টোল দিতে হয়। স্থানীয়দের মতে, “অফিস খরচ” নামের এই অবৈধ চাঁদা না দিলে প্রকল্পের বিল পরিশোধ হয় না। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান—মসজিদ, মন্দির, মাদরাসার বরাদ্দ পর্যন্ত নাকি তার এই ‘গোপন রাজস্বনীতির’ বাইরে নয়।
অনিয়মে রাষ্ট্রীয় ক্ষয়ক্ষতির বহুমুখী অভিঘাত, এ ধরনের অনিয়ম ও প্রকল্প লুটে দেশের উন্নয়নচক্র ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি কয়েকটি ভয়াবহ সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে—
জনগণের বিশ্বাসহানি: সরকারি উন্নয়ন ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা ভেঙে পড়ে। অবকাঠামোর মানহানি: ঘুষের কারণে প্রকল্পে মানসম্পন্ন কাজ হয় না, ফলস্বরূপ এলাকায় টেকসই উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়।
রাজস্ব অপচয়: সরকারি টাকার অপব্যবহারে রাষ্ট্রের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়
দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ: একাধিক স্তরে অনিয়ম ছড়িয়ে পড়ে, যা ভবিষ্যত প্রশাসনকেও নৈতিক সংকটে ফেলে।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষতি: যারা প্রকল্পের প্রকৃত সুবিধাভোগী, তারা ন্যায্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়।
অভিযুক্তের দাবি—সর্বস্ব অস্বীকার,
পিআইও অয়ন সাহাকে অভিযোগ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, “আমি কোনো অনিয়ম করিনি। প্রমাণ থাকলে দেখানো হোক।” তার এই বক্তব্য স্থানীয়দের ক্ষোভ আরও উসকে দিয়েছে।
দুদকের বরিশাল বিভাগীয় উপ-সহকারী পরিচালক সুশান্ত রায় বলেন, “প্রমাণ পেলে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এদিকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লিখন বনিক জানান,
“দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেলে তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।” উন্নয়ন প্রকল্পের ঘুষ-দুর্নীতি শুধু ব্যক্তিগত সম্পদ বৃদ্ধির অস্ত্র নয় এটি রাষ্ট্রীয় উন্নয়নযাত্রার ওপর এক গভীর আঘাত। জনগণের করের টাকায় গড়া প্রকল্প যদি ঘুষের গহ্বরে তলিয়ে যায়, তাহলে উন্নয়নের স্বপ্নও ক্রমে ধুলোয় মিশে যাবে।


