
নিউজ ডেস্ক ::
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম নির্ভরযোগ্য চালিকাশক্তি হলো প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। গ্রামে-গঞ্জে দরিদ্র ঘরের সন্তানরা ভিটেমাটি বিক্রি করে, গরু-ছাগল বেচে, কিংবা চড়া সুদে ঋণ নিয়ে পাড়ি জমায় মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া কিংবা ইউরোপে। উদ্দেশ্য—পরিবারের মুখে হাসি ফোটানো এবং দেশের জন্য রেমিট্যান্স পাঠানো। অথচ, সবচেয়ে দুঃখজনক বাস্তবতা হলো—এই পরিশ্রমী মানুষগুলো দেশের মাটিতেই বিদেশ যাওয়ার প্রক্রিয়ায় সীমাহীন হয়রানির শিকার হন।
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের কঠিন শর্ত
‘প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক’—নামের মধ্যেই রয়েছে এক মানবিক প্রতিশ্রুতি। কিন্তু বাস্তবে একজন দরিদ্র শ্রমিক যখন এই ব্যাংকে ঋণের জন্য আবেদন করেন, তখন তাকে বলা হয়, তাকে দিতে হবে তিনজন ব্যাংক চেক। সেই সঙ্গে একজন সরকারি চাকরিজীবী অথবা বড় বেসরকারি চাকরিজীবী গ্যারান্টর।
প্রশ্ন হলো—যে মানুষটি গরিব বলেই বিদেশে যেতে চান, তার পক্ষে কি এইসব শর্ত পূরণ করা সম্ভব? যদি আমার আশেপাশে এমন সক্ষম লোক থাকতো, যারা ব্যাংকে গ্যারান্টর হতে পারে, চেক দিতে পারে—তাহলে আমি নিজে লোন নিতে যেতাম কেন?
এই কঠিন নিয়মের কারণে দরিদ্র শ্রমিকরা বাধ্য হয়ে আবার দালাল ধরেন, চড়া সুদে এনজিও বা মহাজনের কাছ থেকে টাকা নেন। এরপর বিদেশে গিয়ে বছরের পর বছর খেটে সেই ঋণের বোঝা শোধ করতে করতে জীবন কাটিয়ে দেন।
যাদের টাকা আছে, তারা বিদেশ যায় না
আমরা সবাই জানি, যাদের ঘরে টাকা আছে, জমি আছে, তারা বিদেশে গিয়ে শ্রমিকের কাজ করেন না। বরং বিদেশে পাড়ি দেন তারাই, যাদের ঘরে খাবার নেই, যার সন্তানের পড়াশোনা আটকে আছে, যার বাবা-মায়ের চিকিৎসা অসম্পূর্ণ। অথচ প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের কঠিন ঋণ শর্ত তাদের বিদেশ যাওয়ার পথকে আরও কঠিন করে তোলে।
সরকারি গ্যারান্টর চাওয়ার মানে দাঁড়ায়—”তুমি গরিব, তাই বিদেশ যাওয়ার অধিকার তোমার নেই।” অথচ এই রাষ্ট্র তো সেই গরিব প্রবাসীদের পাঠানো টাকায় চলছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে এসেছে প্রায় ২৯ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স—এই বিপুল অর্থ পাঠিয়েছেন সেই সাধারণ প্রবাসী শ্রমিকেরা, যারা নীরবে দেশের জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন।
রেমিট্যান্স বাড়বে কীভাবে?
বর্তমানে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ বিদেশগামী কর্মীদের সংখ্যা হ্রাস পাওয়া। কারণ বিদেশে যেতে হলে যে ব্যয় বহন করতে হয়, তা অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক যদি নিচের মতো কিছু মানবিক ও বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা গ্রহণ করত, তাহলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারত:
জামানতের পরিবর্তে পারিবারিক সদস্যদের দায় স্বীকারপত্র গ্রহণ,
সহজ কিস্তিতে ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা,
দরিদ্র প্রমাণিত শ্রমিকদের ক্ষেত্রে গ্যারান্টর ও চেকের শর্ত বাতিল,
অনলাইন আবেদন প্রক্রিয়া সহজ ও দুর্নীতিমুক্ত করা,
বিদেশ ফেরতদের জন্য পুনর্বাসন (rehabilitation) স্কিম চালু করা।
প্রবাসীদের জন্য রাষ্ট্রীয় সদিচ্ছা প্রয়োজন
প্রবাসীরা কেবল শ্রমিক নন—তারা দেশের অর্থনীতির নীরব যোদ্ধা। অথচ তারা বিমানবন্দরে হয়রানির শিকার হন, ইমিগ্রেশনে সম্মান পান না, দেশে ফিরে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালেও চরম অবহেলার সম্মুখীন হন। অথচ এই মানুষগুলো পরিবার ছেড়ে হাজার হাজার মাইল দূরে থাকেন, কেবল দেশের মঙ্গলের জন্য।
তাদের পাশে দাঁড়ানো মানে দেশের পাশে দাঁড়ানো। তাই সরকারের উচিত—
ঋণ প্রাপ্তির প্রক্রিয়া সহজ করা,
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের ‘কল্যাণ’ শব্দের যথার্থতা প্রমাণ করা,
দালালমুক্ত ও গরিববান্ধব নীতিমালা চালু করা।
শেষ কথা
যদি প্রবাসীদের পাশে রাষ্ট্র দাঁড়ায় না, তাহলে ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতি হোঁচট খাবে। কারণ প্রবাসে যাওয়ার সংখ্যা কমলে রেমিট্যান্সও কমবে। সময় এসেছে—‘প্রবাসীদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ’—এই দাবি পূরণে সরকার ও প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের মানবিক ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করার।
প্রত্যেক দরিদ্র তরুণ যেন বিদেশ যেতে পারে, আর দালালের শিকার না হয়—এই হোক আমাদের রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার।