
মামুনুর রশীদ নোমানী,বরিশাল :: বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবু মামুনের বিরুদ্ধে আর্থিক অস্বচ্ছতা,দুর্নীতি,অনিয়ম,সরকারি টাকা আত্মসাৎ,কর্তব্যে অবহেলা,সরকারি অর্থ আত্মসাতে সহযোগীতা প্রদান,স্বেচ্ছাচারিতা,গোপনে নিয়োগ,শিক্ষার্থীদের টিফিনের টাকা নয়ছয়সহ নানা অভিযোগ।
সকল অভিযোগ অস্বিকার করে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবু মামুন কলেজে যাওয়ার আমন্ত্রন জানালেন।
বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজটি সরকারি হলেও শিক্ষার মান বাড়েনি ।স্কুলের শিক্ষক দিয়ে কলেজে পাঠদান করানো হচ্ছে। শিক্ষার মানোন্নয়নে নজর না দিলেও দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে ভুয়া বিল-ভাউচার করে দু হাতে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন।বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটিতে ঘটছে অর্থ তছরুপের ঘটনা।অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে প্রতিষ্ঠানটির সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে।
অধ্যক্ষের দ্বায়িত্ব নেয়ার পরেই আবু মামুন পছন্দের কয়েকজন শিক্ষকদের নিয়ে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন।এই সিন্ডিকেট সদস্যদের দেয়া হয় বিধি বহির্ভুত সুযোগ -সুবিধা।এমনকি পরীক্ষার ডিউটি আদায় না করলেও দেয়া হয় পরীক্ষা ডিউটির সম্মানী।
আবু মামুনের আর্থিক অনিয়মের পাশাপাশি দায়িত্বে অবহেলা, প্রশাসনিক পক্ষপাতিত্ব এবং দুর্নীতির কারণে কলেজের সার্বিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে বলে একাধিক শিক্ষকরা জানিয়েছেন।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ফ্যাসিস্ট সাদিক আব্দুল্লাহর ঘনিষ্ঠ অনুচর এহতেশাম উল হককে ২০২৪ সালের ১৪ নভেম্বর বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষের পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার পরই ভাগ্য খুলে যায় আবু মামুনের।ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দ্বায়িত্ব পেয়েই দুর্নীতি,অনিয়ম আর আর্থিক অনিয়মে জড়িয়ে পরেন।
নিষিদ্ধ গাইড বই চলে,টাকার বিনিময়ে :
আবু মামুন দ্বায়িত্ব নেয়ার পর নিষিদ্ধ গাইডের ফেরিওয়ালা হয়ে গেলেন তিনি।
সকল শিক্ষকদের পাঞ্জেরী গাইড দিয়ে পরীক্ষার প্রশ্ন করার এবং শিক্ষার্থীদের পাঞ্জেরী গাইড ক্রয়ের জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। কলেজে পাঞ্জেরী গাইড ব্যবহার করায় পাঞ্জেরী প্রকাশনা কর্তৃপক্ষ আবু মামুনকে নগদ তিন লাখ টাকা প্রদান করেন। পাঞ্জেরী গাইড বিষয়ে পাঞ্জেরী প্রকাশনীর সিনিয়র অফিসার আনিসুর রহমানের সাথে বরিশাল সরকারি মহিলা কলেজের পিছনের গেট এলাকায় (ফকিরবাড়ি রোড) বসে এ নিয়ে রফাদফা হয়। অথচ সরকার গাইড বই নিষিদ্ধ করেছে।সরকারি কর্মচারী হয়েও সরকারের নির্দেশ অমান্য করছেন আবু মামুন। পাঞ্জেরী প্রকাশনীর প্রতিনিধি আনিসুর রহমান টাকা দেয়ার বিষয়টি স্বিকার করে বলেন, তিন লাখ না তবে টাকা দেয়া হয়েছে এটা সত্য।আবু মামুন টাকা পেয়ে তার সিন্ডিকেট শিক্ষক সদস্যদের মাঝে বিতরন করেন।এ ব্যাপারে বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজের একাধিক শিক্ষার্থীরা বলেন,সব প্রশ্ন পাঞ্জেরী গাইড থেকে করা হয়।আমরা বাধ্য হয়ে পাঞ্জেরী গাইড ক্রয় করি। এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন,আবু মামুন স্যার দ্বায়িত্ব নেয়ার পরেই সকল শিক্ষককে পাঞ্জেরী গাইড থেকে প্রশ্ন করার জন্য বলেছেন এবং শিক্ষার্থীদের ঐ গাইউ ক্রয়ের জন্য সাজেস্ট করতে বলেছেন।
গাইড বই, আইন কি বলে :
১৯৮০ সালের নোটবই নিষিদ্ধকরণ আইনের ৩ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি নোট বই মুদ্রণ, প্রকাশনা, আমদানি, বিক্রয়, বিতরণ অথবা কোনো প্রকারে এর প্রচার করতে বা মুদ্রণ, প্রকাশনা, বিক্রি, বিতরণ কিংবা প্রচারের উদ্দেশ্যে রাখতে পারবেন না। এই আইন অমান্য করলে সর্বোচ্চ সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রাখা হয়েছে। পরে একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নোটবই নিষিদ্ধকরণ আইনের আওতায় নোটবইয়ের সঙ্গে গাইডবইও বাজারজাত ও বিক্রি নিষিদ্ধ করেন হাইকোর্ট। কিন্তু তারপরও আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজে প্রকাশ্যেই নোট ও গাইড বইয়ের ব্যবহার চলছে। গাইড বই বাজারজাত করতে পাঞ্জেরী ও লেকচার প্রকাশনীর প্রতিনিধিদের সাথে দরকষাকষি করছেন আবু মামুন। শিক্ষার্থীদের পাঞ্জেরী প্রকাশনীর গাইডবই কিনতে ক্লাসে বলে দেওয়ার জন্য লাখ লাখ টাকা ঘুষ নিচ্ছেন। এ ছাড়াও উন্নয়ন তহবিল ও বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের নামে টাকা দিচ্ছেন ৬ মাসে একাধিকবার।
স্টাফ কাউন্সিলের তহবিল দিয়ে ভ্রমন বিলাস :
এদিকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোঃ আবু মামুনের বিরুদ্ধে কলেজের স্টাফ কাউন্সিলের তহবিল থেকে ৪৬ হাজার টাকা উত্তোলন করে তার সিন্ডিকেট শিক্ষকদের নিয়ে কক্সবাজার ভ্রমন করেন।প্রতিষ্ঠানটির আয় থেকে শতকরা দু ভাগ টাকা জমা হয় স্টাফ কাউন্সিল ফান্ডে।স্টাফ কাউন্সিলের টাকা গুটিকয়েক ব্যক্তির ভ্রমন বিলাসের জন্য নয় এমন মন্তব্য করেছে এক শিক্ষক।তিনি বলেন,এটা সম্পুর্ন অন্যায় ও অনিয়ম।
শিক্ষার্থীদের টিফিনের টাকা আত্মসাৎ:
শিক্ষার্থীদের টিফিনের টাকা দিয়ে বাৎষরিক পরীক্ষায় বিরিয়ানী খাওয়ানোর রেওয়াজ রয়েছে।অথচ আবু মামুন দ্বায়িত্ব নেয়ার পরে শিক্ষার্থীদের বিরিয়ানী না দিয়ে ১ লাখ ৮০ হাজার টাতা আত্মসাৎ করেছেন বলে কলেজে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।
শুধু তাই নয় বাৎষরিক কেনা কাটা বাবদ প্রায় ৮ লাখ টাকার অধিকাংশ টাকা আত্মসাৎ করেছে ভুয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে। সাবেক অধ্যক্ষ এহতেশাম উল হক চলে যাওয়ার পরেই ছোট ছোট ৩৫ টি নামকাওয়াস্তে প্রকল্প বানিয়ে সরকারি অর্থ লোপাট ও অর্থ তসরুপের অভিযোগ উঠেছে।
গোপনে তিনজনকে নিয়োগ :
বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজ খোদ সরকারি হলেও সরকারি নিয়ম কানুন ও বিধি বিধান লঙ্গন করে তিনকে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেয়া হয়।মোটা অংকের উৎকোচের বিনিময়ে অতি গোপনে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবু মামুন এই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন।নিয়োগের ক্ষেত্রে বিজ্ঞপ্তি পর্যন্ত দেয়া হয়নি।
ইলেকট্রিশিয়ান পদে ইউসুফ,কম্পিউটার অপারেটর পদে শামিম ও অফিস সহকারি পদে ওলিকে নিয়োগ প্রদান করা হয়।
নিয়োগের ক্ষেত্রে সাময়িক শ্রমিক নিয়োজিতকরণ নীতিমালা ২০২৫ অনুসরন করা হয়নি।এমনকি শ্রমিক নিয়োগ সংক্রান্ত বিধি/প্রবিধি/নীতিমালা রয়েছে।এসব বিধি অমান্য করা হয়েছে। এছাড়া নিয়োগের ক্ষেত্রে সাময়িক শ্রমিক নিয়োজিতকরণ নীতিমালা ২০২৫ কার্যকর এবং অর্থ বিভাগের মতামত গ্রহণ করে নাই।ফলে নিয়োগটি অবৈধ ও ঘুষের বিনিময় হয়েছে বলে মনে করেন বিশিষ্ট আইনজীবী এ্যাড.জিয়াউর রহমান।
অর্থ আত্মসাতে নিম্মমানের ক্রীড়া সামগ্রী প্রদান:
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবু মামুনের বিরুদ্ধে ক্রিড়া প্রতিযোগীতায় নিম্মমানের উপহার সামগ্রী দেয়া,নিজের লোকদের দিয়ে ক্রয় করে ভুয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে উপহার সামগ্রীর নামে অর্থ আত্মসাৎ,পরীক্ষা ডিউটি না করেও শিক্ষক অহিদুজ্জামানকে পরীক্ষা ডিউটির সম্মানী দেয়াসহ গুরুতর অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটিতে বিশৃংখলা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
সিন্ডিকেট শিক্ষক সদস্যদের বাড়তি সুবিধা :
এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন শিক্ষককে অতিরিক্ত সুবিধা দেয়ার জন্য বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের দোহাই দিয়ে সেসব শিক্ষকদের পরীক্ষার ডিউটি না দেয়া। ফলে এসব শিক্ষকরা মাসের পর মাস বাড়িতে অবস্থান করার সুযোগ পাচ্ছে।এর মধ্যে এক শিক্ষক গত ৭ মাসে দু’দিনও প্রতিষ্ঠানে না এসে হাজিরা খাতায় উপস্থিতির স্বাক্ষরও রয়েছে। এছাড়া মোস্তফা কামাল নামে এক শিক্ষক বরিশালে একটি প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন।তিনি নিজের মত করে আসেন এবং চলে যান।তার ব্যাপারে নিরব ও নিশ্চুপ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবু মামুন।কারন হিসেবে জানা গেছে শিক্ষক মোস্তফা কামাল আবু মামুন শিক্ষক সিন্ডিকেটের সদস্য।
কাজ সম্পুর্ন না হলেও বুঝে নিলেন দায় নিয়ে:
বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজে প্রায় ১৮ লাখ টাকার ফ্লোর মোজাইকের কাজ চলমান। অথচ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এক মাস আগে নিজে দায় নিয়ে সম্পুর্ন কাজ সম্পন্ন হয়েছে মর্মে বুঝে নিয়েছেন।জানা গেছে ,ফ্লোর মোজাইকের ১৮ লাখ টাকা থেকে উৎকোচ নিয়েছেন আবু মামুন।কারন হিসেবে জানা গেছে,কাজ সম্পন্ন না হওয়ার আগে সকল টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক অহিদুজ্জামান বলেন,আমি পরীক্ষার ডিউটি পালন না করেই সম্মানী নিয়েছি এটা সঠিক।তবে আমি পরীক্ষা কমিটিতে ছিলাম। তাই হয়তো সম্মানী দেয়া হয়েছে।ক্রীড়া সামগ্রী কেনাকাটায় তিনি কমিটির লোক না হয়েও কেনা কাটার কথা অপকটে স্বিকার করেছেন।
এ ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানটির হিসাব রক্ষক আমির হোসেন বলেন, ২০২৪ সালে শিক্ষার্থীদের বিরিয়ানী খাওয়ানো হয়নি তবে এবছর বিরিয়ানী খাওয়াবো। আর্থিক অনিয়ম, অর্থ আত্মসাৎ, অনিয়ম ও দুর্নীতির ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি অধ্যক্ষের কাছ থেকে জানার পরামর্শ প্রদান করেন।
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোঃ আবু মামুন বলেন, যে সব প্রশ্ন করেছেন তা সবই মিথ্যা।যা করেছি স্টাফ কাউন্সিলের অনুমোদন নিয়েই করেছি।এছাড়া সব জানতে কলেজে চায়ের আমন্ত্রন জানান।
উল্লেখ্য,২০০৭ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকার বরিশাল নগরীর রাজা বাহাদুর সড়ক ও বেলস পার্কের উত্তর পাশে ১ একর ৮ শতাংশ জমির ওপর স্থাপন করেন বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজ।২০০৬ সালের ৩১ জানুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির একসভায় প্রকল্পটি গৃহীত হয় ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়।
২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রনালয় থেকে জারিকৃত এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বরিশাল মডেল স্কুল এন্ড কলেজটিকেও সরকারিকরন করা হয়।
এ প্রতিষ্ঠানটিতে কর্নেল ড. সিরাজুল ইসলাম উকিল যিনি সরকারী ও বেসরকারি থাকাকালীন অধ্যক্ষের দ্বায়িত্ব পালন করেন। তিনি আমুল পরিবর্তন করেছিলেন শিক্ষার মানোন্নয়নে ।
এছাড়া তিনি প্রথম সিসিটিভির আওতায় এনেছিলেন এ প্রতিষ্ঠানটি। অনিয়মিত শিক্ষকদের সরকারি করন এবং কলেজটি সরকারি করনে তার ব্যাপক অবদান ছিল। তার কারনেই বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজ বরিশালে পরিচিতি ও সুনাম ছড়িয়েছিল।