
নিজস্ব প্রতিবেদক :: কোন পারিশ্রমিক ছাড়াই ২ হাজার কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন ডা. কামরুল ইসলাম।
এক হাতেই দুই হাজার কিডনি প্রতিস্থাপন। বিনিময়ে নেননি কোনও সার্জন ফি, যা টাকার অঙ্কে কমপক্ষে ২০ কোটি। অধ্যাপক হয়েও নিয়মিত রোগী দেখেন মাত্র ৪০০ টাকা ফি’তে— তিনি ডা. কামরুল ইসলাম। কিডনি রোগীদের জন্য গড়ে তুলেছেন একটি হাসপাতাল। তার কাছে রোগী সেবা যেন আরেক ইবাদত।
মঙ্গলবার (২৪ ডিসেম্বর) ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি (সিকেডি) হাসপাতালে সফলভাবে সম্পন্ন হয় তার ২ হাজারতম কিডনি প্রতিস্থাপন। দেশে এ পর্যন্ত যেসব কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে, তার প্রায় অর্ধেকই সম্পন্ন হয়েছে তার নেতৃত্বে।
১১ জন চিকিৎসকসহ তার টিমে রয়েছেন ২১ সদস্য। ২০০৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রতিস্থাপন হয়েছে দুই হাজার কিডনি। অস্ত্রোপচারের সফলতার হার ৯৬ শতাংশ।
নিজ পেশায় মহানুবতা ও মানবসেবার এক দুর্দান্ত মেলবন্ধন তৈরি করেছেন ডা. কামরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘একটা মানুষ যখন ভালো হয়ে যায়, এই ভালো কাজ থেকে যে ভালো লাগা, এটা একটা বড় স্পৃহা আপনার পরবর্তী কাজটা করার জন্য। সপ্তাহে ছয় দিনই ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে হচ্ছে। তারপরেও রোগীর এত চাপ, দেখা যায় যে ১০০টা রোগী বসে আছে। মাসে আমরা এখন ২৫ থেকে ২রটা ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে পারি। তাহলে ১০০ রোগীর চিকিৎসা করতে আমার চার মাস লেগে যাবে।
মূলত, বিদেশে কিডনি প্রতিস্থাপন ব্যয় দাঁড়ায় ৩০ থেকে ৫০ লাখ টাকা। আর অধ্যাপক কামরুলের হাসপাতালে তা সব মিলিয়ে খরচ ২ লাখ ১০ হাজার। কিডনি প্রতিস্থাপন করা চিকিৎসকদের ফলোআপ চিকিৎসাও দেন বিনামূল্যে, নেন না ভিজিট। লাগে না রোগ নির্ণয়ের ফি পর্যন্ত। শুধু তাই নয়, হাসপাতালে ভর্তি রোগীরা খাবার পান বিনামূল্যে।
ডা. কামরুল ইসলামের ভাষ্য, ‘আমার যে আয় হয়, সে আয়টাও আল্লাহ পাকের। আমি ব্যাপারটা এভাবেই অনুভব করি। এই পুরোটা আমার অর্থ নয়।। আমার মানিটুকু আমার যেটুকু দরকার… হয়তো খাওয়া-দাওয়া দরকার, বাসা ভাড়া দরকার, গাড়ির দরকার… এই ইয়ে দরকার, এগুলো মধ্যম পন্থায় করতে হবে। ভিজিট দিয়েই যাবে, আর না দিতে পারলে নিলাম না। কত রোগী দেখতেছি, একটা দুইটা না নিলে কি আসে যায়? কিচ্ছু আসে যায় না। দিতে পারলে যেটুকু দিলো, ওই পরিমাণটা আমি একটু কমায়ে রাখতে চাই। আমি এখন রোগী দেখি যে ওর কষ্ট লাঘব করব, ওর এনজাইটিটাকে লাঘব করব, ওর বিপদ থেকে উদ্ধার করব। এই তিনটা টার্গেট নিয়ে করি। এইভাবে আমার কাজটাকে, সমস্ত ইয়েটাকে এই ফরম্যাটে আনার চেষ্টা করছি, যাতে করে আমার কাজটাও যাতে ইবাদত হয়ে যায়।’
২০১৪ সালে নিজের জমানো টাকা আর বন্ধুদের সহায়তায় রাজধানীর শ্যামলীতে গড়ে তোলেন সিকেডি হাসপাতাল। তখন থেকেই ৪০০ টাকা ফিতে রোগী দেখেন তিনি। এর মধ্যে একটা বড় অংশের কাছে আবার কোনো ভিজিটই রাখেন না।
ডাক্তার দেখাতে আসা এক রোগী বলেন, ‘কামরুল স্যার যদি এখানে না আসতেন, তাহলে আমি ভারতে চলে যেতাম। প্রক্রিয়াও চলছিল।’ অপরজন বলেন, ‘কিডনি প্রতিস্থাপনের পর থেকে আমার মানে মূলত যেই ভিজিটের টাকা ওটা লাগে না। আর যেই টেস্টগুলা করানো হয় ওই টেস্টের টাকাও স্যার রাখে না। একদম ফ্রিতেই আমাদের দেখে দেয়, ফলোআপ।
আরেক রোগীর কাছে ডাক্তার সাহেব যেন ভরসার অন্য নাম। বলেন, ‘সিএমসি হসপিটাল, অ্যাপোলো হসপিটাল, চেন্নাই গ্লোবাল… আরও অনেক জায়গাতে দেখিয়েছি। কলকাতাতেও দেখিয়েছি কয়েক জায়গাতে। আমার কাছে মনে হয়েছে কামরুল স্যারের কাছে আস্থা পাওয়া যায়। আমি যে আস্থাটা পুরোপুরিভাবে ভারতেও পাচ্ছিলাম না।’
হাসপাতালটির এক কর্মকর্তা জানান, এই হসপিটালে ৪৫০ জনার বেশি স্টাফ চাকরি করে। এর মাঝে ২০০ জনার বেশি স্টাফ তাদের থাকার যে আবাসিক ব্যবস্থাটা তা ডাক্তার কামরুলেরি করা। সাথে সকল স্টাফদের জন্য এবং ভর্তি সকল রোগীর জন্য তিন বেলা খাবারও এখানে ফ্রি।
অবশ্য, কামরুল ইসলামের দেশসেরা চিকিৎসক হওয়ার পেছনে তার মা অধ্যাপিকা রহিমা খাতুনের অবদান অনেক। ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি তার স্বামীকে হারান। এরপর মাধ্যমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত নিজে পড়েছেন, পড়িয়েছেন তার চার সন্তানকে।
নিজ সন্তান সম্পর্কে মায়ের মুখে শোনা গেল গর্বের স্তুতি। বলেন, শুধু সেবা করেই যেন ওর জীবনটা কাটায়, আমি এটাই চেয়েছি। এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে শুধু বলতাম, আল্লাহ ওর হায়াতকে বৃদ্ধি করুন শুধু মানুষের উপকারের জন্য, আমাদের জন্য না। মানুষের উপকার করে মানুষ যদি বেঁচে যায়, তাহলে আমরাও বেঁচে থাকব।
উল্লেখ্য, একটি হাসপাতালের মালিক হলেও সাধারণ জীবনযাপনেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন মানবতার এই ফেরিওয়ালা। আর নিজের আয়ের পুরোটাই ব্যয় করেন রোগীদের সেবায়। ডাক্তারি পেশা, যাকে বলা হয় মানবসেবা— এর যথার্থ তথা বাস্তব উদাহরণ হলেন ডা. কামরুল ইসলাম।


