
আরিফ আহমেদ :: একদিকে বরিশালের জেলা প্রশাসক দেলোয়ার হোসেন এর উদ্যোগে নগরীর সাতটি খালকে ঘীরে চলছে পরিচ্ছন্নতা অভিযান। অন্যদিকে বরিশালের গুরুত্বপূর্ণ দুটো বাজারের সব প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্যসহ যাবতীয় ময়লা আবর্জনা ছুড়ে ফেলা হচ্ছে খাল ও নদীতে। যে কারণে ব্যহত হচ্ছে পরিচ্ছন্নতা অভিযান। কেননা এই ময়লা আবর্জনা জোয়ারের পানিতে পুনরায় ভিতরের খালগুলো ভরাট করে দিচ্ছে। আবার ভাটার সময় অনেক ভাসমান প্লাস্টিক বর্জ্য চলে যাচ্ছে কীর্তনখোলা নদী হয়ে দূরদূরান্তে। যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। সম্প্রতি বরিশালের রিপোর্টার্স ইউনিটির মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তারা এ নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াসও চালিয়েছেন। সরেজমিনে বরিশালের চকবাজার এলাকার হাটখোলা ব্রীজ থেকে জেল খালের ডানে ও বামে দেখা গেছে অসংখ্য প্লাস্টিক বর্জ্য ও ময়লা আবর্জনার স্তূপ। যা রীতিমতো খালপাড় ভরাট করে দিচ্ছে। এই খালের পাড় ধরে পোর্ট রোড বাজারের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে চোখে পড়ে ভাসমান পানির বোতল, পলিথিন ব্যাগ, বিভিন্ন প্লাস্টিক উপকরণ সহ ময়লা আবর্জনা রীতিমতো স্তুপ হয়ে আছে মাছ ঘাট বা ট্রলার ঘাট এলাকায়। (ছবিতে যার প্রমাণ স্পষ্ট।)
মাছ ব্যবসায়ী জহির, লোকমান, রহমান জেলেসহ কয়েকজন বললেন, এগুলো মাছ বাজারের কেউ ফেলেনি। কিছু হয়তো এখানকার অন্য ব্যবসায়ী বা ক্রেতারা ফেলেছেন। তবে বেশিরভাগই ভেসে এসেছে বলে জানান তারা।
এই বাজার এলাকা পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্বকার প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, বাজারের ইজারাদারদের এটা করা উচিত। আবার কেউ বলেন, এটি থেকে লাভবান যেহেতু সিটি করপোরেশন ও নৌ বন্দর কর্তৃপক্ষ। তাই তাদেরই এটি নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে।
সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করলে তারা সড়ক ও বাজারের ময়লা আবর্জনা, ড্রেনগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় বলে জানান। কিন্তু নৌ বন্দর কর্তৃপক্ষের আব্দুর রাজ্জাক এখন ব্যস্ত ইজারা পরিধি বাড়িয়ে সরকারের আয় বাড়াতে। যে ঘাটের ইজারা প্রথা বাতিল করা হয়েছে, তিনি সেগুলোসহ বরিশালের স্প্রীডবোট ঘাটও ইজারার বন্দোবস্ত দিতে চান জানিয়ে বলেন, নদী তীরবর্তী এলাকা এবং এর তলদেশ মেরিন বিভাগ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্ব।
ইতিপূর্বে বরিশালের নৌ বন্দর এলাকা থেকেই টনকে টন প্লাস্টিক বর্জ্য উঠে আসে। যা নিয়ে রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে পড়েন বরিশালের জেলা প্রশাসনসহ সুশীল সমাজ। গত ৫ জুন ২০২৪ সারাদেশের মতো বরিশালেও পালিত হয়েছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘সবাই মিলে করি পণ, বন্ধ হবে প্লাস্টিক দূষণ। এবারের এই প্রতিপাদ্য বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী বলে আলোচনা করলেও পরবর্তীতে এই উদ্যোগ কোন কাজে লাগেনি। ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্লাস্টিক পণ্য বর্জনের জন্য পলিথিন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারী করলে পুনরায় বিষয়টি আলোচিত হতে শুরু করে। রাতারাতি এ নিয়ে দাঁড়িয়ে যায় নতুন এনজিও সংস্থা। ঢাকার মোহাম্মদপুর, মিরপুর, সাভারে বিভিন্ন নামে এখন পরিবেশবাদী এনজিও কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। বরিশালেও এরকম কয়েকটি এনজিও আছে যারা খাতা-কলমে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন অভিযান করলেও বাস্তবে এর দেখা মেলে না।
এমনই একটি সংস্থা গ্রামীণ বাংলা ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে ছুটে এসেছে বরিশালে। প্লাস্টিক দূষণ মোকাবিলায় সাংবাদিকদের ভূমিকা শীর্ষক মতবিনিময় সভার আয়োজন করেন তারা। গত ২২ নভেম্বর শুক্রবার বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটির হল রুমে গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটি ও বাংলাদেশ ওয়েস্ট পিকারস ইউনিয়ন মোবিলাইজেশন ফর অলটারনেটিভ প্রোগ্রাম নামক সংগঠনের আয়োজনে মতবিনিময় অনুষ্ঠান করা হয়। এ সভায় বক্তারা প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহতা এবং এর প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ে আলোচনা করেন। যদিও ইতিপূর্বে এদের কারোই এ নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা চোখে পড়েনি। সভায় জানানো হয়, উন্নত দেশগুলোতে ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম উন্নত হওয়ায় পরিবেশ ঝুঁকি কম হলেও বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এটি ক্রমবর্ধমান হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু ঢাকা শহরেই মাথাপিছু বছরে ২৪ কেজি প্লাস্টিক ব্যবহৃত হচ্ছে বলে দাবী বক্তাদের। তারা বলেন, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে এ দূষণ দেশের পরিবেশকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে।
এর আগে গতবছর ১৫ অক্টোবর বরিশালের কীর্তনখোলা নদীর নাব্যতা সংকট দূর করতে খননের কাজ করতে গেলে রীতিমতো আতঙ্কিত পরিস্থিতি তৈরি হয় ড্রেজার চালকদের মধ্যে। ড্রেজার ভেঙে যাওয়া আতঙ্কে কাজ বন্ধ করে দেন তারা। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে বারবার ময়লা আবর্জনার স্তূপ তুলে পরিষ্কার করে তারপর খনন চালাতে হয়। ঐ সময় বিআইডব্লিউটিএর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মিজানুর রহমান ভূঁইয়া বলেছিলেন, ড্রেজারের কাটারে পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য আটকে যাওয়ায় মেশিন বন্ধ করে বারবার কাটার পরিষ্কার করতে হচ্ছে। এতে খননের সময় ও ব্যয় দুটিই বাড়ছে। বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের নৌপথগুলোর অন্তত ৩০টি স্থানে শুষ্ক মৌসুমে নাব্যতা–সংকটের আশঙ্কায় এসব স্থানে খননের উদ্যোগ নিতে হয় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআইডব্লিউটিএ)। চলতি বছর এখন পর্যন্ত এরকম কোনো উদ্যোগ চোখে পরেনি। তবে নদীতে যাত্রীবাহী বড় লঞ্চের চলাচল কম থাকায় বিষয়টি এখন আলোচনায় আসেনা বলে জানান লঞ্চের চুকানী বা মাস্টার আব্দুল সালাম।
বরিশালের পরিবেশ ও সামাজিক আন্দোলনের নেতা কাজী মিজানুর রহমান বলেন, পলিথিন একটি বড় সমস্যা। এজন্য নদীতে যেমন পলি জমছে, তেমনি প্লাস্টিক বর্জ্য মাছের প্রজননের জন্য হুমকি। তিনি বলেন, এজন্য সবার আগে কারাখানা গুলোর উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। একইসাথে পলিথিনের বিকল্প, প্লাস্টিকের বিকল্প সৃষ্টি ও তার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে বলে জানান তিনি।


