
নিজস্ব প্রতিবেদক :: বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহর বিতর্কিত কর্মকান্ডের মধ্যে একটি ছিলো বিভিন্ন খাতের টাকা নিদিষ্ট একাউন্টে জমা না দেওয়া। ক্ষমতার অপব্যবহার করে কোন নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে তিনি যা ইচ্ছে তাই করতেন। প্রতিবাদ করার সাহস ছিলো না কারোই। কেউ কিছু বললে করা হতো চাকরিচ্যুত না হয় ওএসডি। ফলে কর্মকর্তারাও ভয়ে কিছু বলতেন না। ক্ষমতামলে নানা গুঞ্জন ছিলো বিসিসির বিভিন্ন খাতের টাকা তিনি ব্যাংকে জমা না করে আত্মসাত করেছেন। কিন্তু এ নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলার সাহস কারো ছিলোনা। তবে গণ-অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকার পতনের পর সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহন দুর্র্নীতি-অনিয়মের একে একে তথ্য বেরিয়ে আসছে। যারমধ্যে একটি প্লট বরাদ্দ।
বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের বরাদ্দকৃত ২৪০টি প্লটের ডাউন পেমেন্ট বাবদ গ্রাহকদের দেয়া প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকা নির্ধারিত ব্যাংকের হিসাবে নেই। প্লট বরাদ্দ নিয়েও দলীয়করন ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ রয়েছে স্পষ্ট। বিসিসির বর্তমান প্রশাসন বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করবেন বলে জানিয়েছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মুখে পালানো সাবেক প্রধানমন্ত্রির ফুফাতো ভাই আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর ছেলে সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ মেয়র থাকাকালীন সময়ের শেষ পর্যায়ে ২০২৩ সালে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে ২৪০টি প্লট বিতরন করেন। এই প্লট ক্রয়কারীরা ওই বছরের ১৮ এপ্রিল প্লটের নির্ধারিত মূল্যের ডাউন পেমেন্ট বাবদ নির্ধারিত অর্থ বরিশাল আইএফআইসি ব্যাংকে জমা দেন যার সর্বমোট অংক ছিলো ৬ কোটি ৪৩লাখ ৮১ হাজার ৩৪৬ টাকা। কিন্তু ওই ব্যাংকের ০০০০৩৬৭০৪০০৪২ নং হিসেবে এমন কোন টাকা নেই। বলা হচ্ছে তৎকালীন মেয়র বিধি ভঙ্গ এ এটাকা অন্য খাতে নিয়ে ইচ্ছেমত ব্যয় করেছেন।
বিসিসির বাজেট কর্মকর্তা ও প্রধান হিসাবরক্ষক মশিউর রহমান বলেন, আমি বিসিসিতে চাকরি করি ৩৩ বছর। জমি বিক্রি করে আমাদের যে টাকা আয় হয়েছে তা প্রথমে আইএফআইসি ব্যাংকে জমা হয়েছে, সেখান থেকে তৎকালীন মেয়র অন্যত্র স্থানান্তর করে ব্যয় করেছেন যেটা সম্পুর্ণ বিধি বহির্ভূত এবং আইনে কভার করে না। এ টাকা দিয়ে অন্য স্থানে স্থায়ি সম্পদ ক্রয় করা যেতো যা তিনি করেননি। আইনকে তোয়াক্কা না করে নিজের ইচ্ছেমতো খামখেয়ালীর প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। এক খাতের টাকা অন্যখাতে নেয়াটা গুরুতর অপরাধ। আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর সার্চিং দিয়ে দেখেছি যে ওই একাউন্টে এ টাকা নেই। টাকা অন্য খাতে ব্যয় করা হয়েছে। মেয়রের নির্দেশ পালন না করলে কপালে যা হবার তাই হয়। ওই মেয়র বিসিসির ২৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারিকে বিনা অপরাধে চাকুরিচ্যুত করেছে, আমিও তার মধ্যে একজন। উনি ছিলেন বেপরোয়া এবং ওয়াদা বরখেলাপকারি।
ডাউন পেমেন্টের সাড়ে ৬ কোটি টাকা দিয়ে প্লট এলাকার নাগরিক সুবিধা বাড়ানোর কথা ছিলো। খোদ স্টেট অফিসারের দাবি ছিলো যে এ টাকা অন্য কোন কাজে ব্যবহারের সুযোগ নেই। তার মতে প্লট বরাদ্দের ক্ষেত্রেও সুস্পষ্ট বিধিমালা রয়েছে।
বিসিসর স্টেট অফিসার মাহাবুবুর রহমান বলেন-প্লট বরাদ্দের নিয়ম ছিলো যারা ফরম কিনেছে তারা এবং সংবাদকর্মিদের উপস্থিতিতে প্রকাশ্যে লটারির মাধ্যমে বরাদ্দ কাজ সম্পন্ন করা। নিয়ম আরো হলো-যারা বরাদ্দ পেয়েছে তাদের কাছ থেকে ডাউন পেমেন্ট নিয়ে জমি বুঝিয়ে দেয়া। এই টাকা নিয়ে প্লট এলাকার রাস্তা ড্রেন পানির লাইন ও বিদ্যুতের খুঁটির উন্নয়ন কাজ হবার কথা তাদেরকে নাগরিক সুবিধা দেয়ার জন্য। অন্য কাজে এটা ব্যয় করার কোন সুযোগ নেই।
নগরির কাউনিয়া এলাকায় ৭ একর জমি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত এই হাউজিং এর প্লট বরাদ্দের জন্য তিন সহস্রাধিক নগরবাসি আবেদন করেছিলো। কথা ছিলো বিসিসি এলাকার মধ্যে যাদের জমি-ঘর আছে তারা প্লটের দাবি করতে পারবে না। নিয়ম অনুযায়ি অগ্রাধিকার ভিক্তিতে প্লট বিতরণ ও এর উন্নয়ন না হওয়ায় স্থানীয় জনগন প্লটের পুরো কার্যক্রমের উপর উচ্চ আদালত থেকে নিষেধাজ্ঞা আনে। এরা তখন প্লট দখল ও স্থাপনা নির্মানে বাধা দেয় ও বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করলে কার্যক্রম স্থগীত হয়ে যায়। গোটা এলাকায় এ নিয়ে বিরাজ করছে উত্তেজনা ও ক্ষোভ।
ভুক্তভোগী একজন বলেন-কথা ছিলো বিসিসি এলাকার মধ্যে যাদের জমি-ঘর আছে তারা প্লটের দাবি করতে পারবে না। কিন্তু মেয়র নিয়মনীতি উপেক্ষা করে নিজের দলীয় লোকজনদের মধ্যে প্লট বিতরণ করে। আমাদের কোন মূল্যায়ন করা হয়নি। আমরা মামলা করে কার্যক্রম স্থগীত করে রেখেছি।
অন্যজন বলেন-৩০০০ টাকা দরে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ প্লটের ফরম কিনেছিলো। কিন্তু রাতের অন্ধকারে বরাদ্দের কাজ সেরে ফেলা হয়। আমাদের প্রশ্ন টাকাগুলো কোথায় গেলো। কেন সিটি বিধি উপেক্ষা করা হলো তা আমরা জানতে যাই।
১৯৬১ সালে যখন জনস্বার্থের দোহাই দিয়ে ময়লাখোলা করার জন্য আমাদের জমি একোয়ার করা হয় । বিসিসি কিছুদিন ময়লা ফেলে এই জমি নিয়ে বানিজ্যিকভাবে প্লট বিক্রি শুরু করে। আমার বাসার সামনে থেকে আমি বের হতে পারি না, অগ্রাধিকার উপেক্ষা করে অন্য লোককে এজমি দেয়া হয়েছে। জনস্বার্থ ব্যাহত হওয়ায় জেলা প্রশাসন এ জমির খাজনা নেওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে।
অন্যজন বলেন- প্লট বরাদ্দের নামে ফ্যাসিস্ট নেতৃত্ব আমাদের খাল-রাস্তা সব কিছুই দখল করে নেয়। আমরা এখন সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতায় ভুগি, রাস্তায় চলতেও পারি না।
বিসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল বারি বলেন-
প্লট নিয়ে একটি মামলা চলমান আছে। এজন্য আমরা কিস্তি তুলতেও পারছি না। আমাদের কয়েকটি বড় আয় বন্ধ আছে। মামলার নিস্পত্তি হলে আমরা পরবর্তি উদ্যোগগুলো গ্রহণ করবো। মামলা চলাকালে আমরা কিছুই করতে পারছি না।
উল্লেখ্য ২৪০টি প্লট এলাকার জমির সর্বমোট মূল্য ধরা হয়েছে ১৩ কোটি ৬৩ লাখ টাকা ।